বিশেষ দ্রষ্টব্য: এই লেখাটি শুধুমাত্র সাধারণ তথ্যের জন্য। জন্ডিস কোনো সাধারণ রোগ নয়, বরং এটি লিভারের মারাত্মক কোনো সমস্যার লক্ষণ হতে পারে। তাই অবহেলা না করে দ্রুত একজন রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
জন্ডিস: কেন হয়, লক্ষণ, চিকিৎসা ও প্রতিরোধের উপায় | A to Z গাইড
আমাদের আশেপাশে অনেকেই জন্ডিসে আক্রান্ত হন। চোখ ও শরীর হলুদ হয়ে যাওয়া দেখলেই আমরা ভয় পেয়ে যাই। কিন্তু জন্ডিস নিজে কোনো রোগ নয়, বরং এটি শরীরের ভেতরের কোনো রোগের লক্ষণ মাত্র। মূলত লিভার বা যকৃতের সমস্যা হলেই জন্ডিস দেখা দেয়। চলুন, এই বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত এবং সহজ ভাষায় জেনে নেওয়া যাক।
চিত্র: জন্ডিসে চোখ হলুদ হয়ে যায়
জন্ডিস কি? (What is Jaundice?)
রক্তে বিলিরুবিন (Bilirubin) নামক একটি হলুদ রঞ্জক পদার্থের পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে বেড়ে গেলে ত্বক, চোখের সাদা অংশ (স্ক্লেরা) এবং শ্লেষ্মা ঝিল্লি হলুদ হয়ে যায়। এই অবস্থাকেই জন্ডিস বলা হয়। বিলিরুবিন তৈরি হয় লোহিত রক্তকণিকা (Red Blood Cells) ভেঙে যাওয়ার ফলে। সাধারণত, আমাদের লিভার এই বিলিরুবিনকে শরীর থেকে ছেঁকে মলের মাধ্যমে বের করে দেয়। কিন্তু যখন লিভার ঠিকমতো কাজ করতে পারে না বা অন্য কোনো কারণে বিলিরুবিন শরীর থেকে বের হতে পারে না, তখন রক্তে এর মাত্রা বেড়ে গিয়ে জন্ডিস দেখা দেয়।
জন্ডিসের প্রধান লক্ষণগুলো কী কী?
জন্ডিসের সবচেয়ে পরিচিত লক্ষণ হলো শরীর হলুদ হয়ে যাওয়া। এছাড়াও আরও কিছু লক্ষণ প্রকাশ পায়:
- চোখ ও প্রস্রাবের রঙ গাঢ় হলুদ হয়ে যাওয়া।
- শরীর প্রচণ্ড দুর্বল লাগা ও ক্লান্তি।
- হালকা জ্বর বা গা ম্যাজম্যাজ করা।
- খাবারে অরুচি এবং বমি বমি ভাব।
- পেটের ডানদিকে, অর্থাৎ লিভারের স্থানে ব্যথা অনুভব করা।
- অনেক সময় পায়খানার রঙ ফ্যাকাশে বা সাদাটে হয়ে যায়।
- শরীর চুলকানো।
জন্ডিস কেন হয়? প্রধান কারণসমূহ
বিভিন্ন কারণে জন্ডিস হতে পারে। কারণগুলোর ওপর ভিত্তি করে জন্ডিসকে প্রধানত তিন ভাগে ভাগ করা হয়:
- প্রি-হেপাটিক জন্ডিস (Pre-hepatic): লিভারে বিলিরুবিন পৌঁছানোর আগেই যখন রক্তে এর পরিমাণ বেড়ে যায়। যেমন—অতিরিক্ত লোহিত রক্তকণিকা ভাঙার কারণে (হেমোলাইটিক অ্যানিমিয়া, ম্যালেরিয়া)।
- হেপাটিক জন্ডিস (Hepatic): যখন লিভারের কোষ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণে বিলিরুবিন শোষণ বা নিষ্কাশন করতে পারে না। এর প্রধান কারণগুলো হলো:
- ভাইরাল হেপাটাইটিস (এ, বি, সি, ডি, এবং ই ভাইরাস)।
- অতিরিক্ত মদ্যপানজনিত লিভার রোগ (Alcoholic Liver Disease)।
- কিছু ঔষধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া।
- লিভার সিরোসিস।
- পোস্ট-হেপাটিক জন্ডিস (Post-hepatic): লিভার থেকে বিলিরুবিন বের হওয়ার পথে কোনো বাধা সৃষ্টি হলে। যেমন—পিত্তনালিতে পাথর, টিউমার বা কোনো সংক্রমণের কারণে পথ বন্ধ হয়ে গেলে।
নবজাতকদের ক্ষেত্রেও জন্ডিস দেখা যায়, যা সাধারণত ফিজিওলজিক্যাল জন্ডিস নামে পরিচিত এবং কিছুদিন পর নিজে থেকেই ভালো হয়ে যায়। তবে কিছু ক্ষেত্রে এটি গুরুতরও হতে পারে।
জন্ডিস হলে করণীয় ও চিকিৎসা
যেহেতু জন্ডিস একটি লক্ষণ, তাই এর চিকিৎসা নির্ভর করে মূল কারণের ওপর। ডাক্তার রক্ত পরীক্ষা (যেমন: Serum Bilirubin, LFT) এবং অন্যান্য পরীক্ষার মাধ্যমে কারণ নির্ণয় করে চিকিৎসা শুরু করেন।
- বিশ্রাম: রোগীকে পূর্ণ বিশ্রামে থাকতে বলা হয়, কারণ এতে লিভার দ্রুত সেরে ওঠে।
- সঠিক খাবার: সহজপাচ্য ও স্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণ করতে হয়।
- ঔষধ: মূল রোগ অনুযায়ী ডাক্তার অ্যান্টি-ভাইরাল, অ্যান্টিবায়োটিক বা অন্যান্য প্রয়োজনীয় ঔষধ দিয়ে থাকেন।
- ঝাড়ফুঁক বা কবিরাজি নয়: জন্ডিস হলে অনেকেই ঝাড়ফুঁক, তাবিজ বা কবিরাজি চিকিৎসার শরণাপন্ন হন, যা একেবারেই অনুচিত এবং বিপজ্জনক। এতে লিভারের আরও বড় ক্ষতি হতে পারে।
জন্ডিস রোগীর খাবার তালিকা
সঠিক খাবার জন্ডিস থেকে দ্রুত আরোগ্য লাভে সহায়তা করে।
কি কি খাবেন?
- বেশি করে পানি ও তরল: শরীরকে সতেজ রাখতে প্রচুর পরিমাণে বিশুদ্ধ পানি, ডাবের পানি, আখের রস ও ফলের রস পান করুন।
- সহজপাচ্য শর্করা: নরম ভাত, জাউ, রুটি, সিদ্ধ আলু ইত্যাদি।
- ফলমূল: পেঁপে, আনারস, বেদানা, কমলালেবুর মতো ফল হজমে সাহায্য করে।
- শাকসবজি: সবজি ভালোভাবে সিদ্ধ করে খেতে হবে।
কি কি খাবেন না?
- তেল, চর্বি ও মশলাযুক্ত খাবার পুরোপুরি পরিহার করতে হবে।
- ফাস্ট ফুড, ভাজাপোড়া ও প্রক্রিয়াজাত খাবার।
- অতিরিক্ত প্রোটিন জাতীয় খাবার যেমন লাল মাংস।
- অ্যালকোহল বা যেকোনো ধরনের মাদকদ্রব্য।
কিভাবে জন্ডিস প্রতিরোধ করবেন?
কিছু সাধারণ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে জন্ডিসের ঝুঁকি অনেকাংশে কমানো সম্ভব:
- বিশুদ্ধ পানি ও খাবার: সবসময় নিরাপদ ও বিশুদ্ধ পানি পান করুন এবং স্বাস্থ্যকর খাবার খান।
- পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা: খাবার তৈরি ও খাওয়ার আগে এবং টয়লেট ব্যবহারের পর সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে নিন।
- হেপাটাইটিস টিকা: হেপাটাইটিস এ এবং বি ভাইরাসের টিকা নিয়ে নিন।
- নিরাপদ রক্ত সঞ্চালন: রক্ত নেওয়ার আগে অবশ্যই তা পরীক্ষা করে নিন।
- মদ্যপান পরিহার: অতিরিক্ত মদ্যপান লিভারের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।
শেষ কথা: জন্ডিস নিয়ে আতঙ্কিত না হয়ে সচেতন হন। এর লক্ষণ দেখা দিলে অবহেলা না করে একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিন এবং তার নির্দেশনা মেনে চলুন। সুস্থ জীবনযাপনের মাধ্যমেই লিভারকে সুরক্ষিত রাখা সম্ভব।
0 comments:
Post a Comment